খবরের বিস্তারিত...


কবর যিয়ারতের শরয়ী বিধান——অধ্যাপক মুহাম্মদ নুর হোসাইন

যিয়ারত অর্থ সাক্ষাৎ করা, ভ্রমন করা, মিলিত হওয়া ইত্যাদি। ইসলামি পরিভাষায় মৃত মুসলিম ব্যক্তির কবরে গিয়ে পবিত্র কুরআন তিলাওয়াত, দরূদ-সালাম ও দোয়া-আদিয়া পাঠোত্তর কবরবাসী ও নিজের জন্য দোয়া করাকে যিয়ারত বলা হয়। ইসলামের প্রথম যুগে কবর যিয়ারত নিষিদ্ধ ছিল। পরবর্তীকালে যিয়ারতের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আল্লাহ নবি (দ.) কবর যিয়ারত করতেন। তিনি কবর যিয়ারতের একাধিক গুরুত্বও বর্ণনা করেছেন। এমনকি অন্তিম মুহূর্তে তিনি ঘর থেকে বের হয়েছিলেন যিয়ারতের উদ্দেশ্যে। তাঁর খাদেম হযরত আবু মুয়াইহিবা (র.)-কে সাথে নিয়ে জান্নাতুলবাকিতে গিয়ে যিয়ারত করেছিলেন এবং এ প্রসঙ্গে বলেছেন, “আমি বাকি বাসীদের যিয়ারতের জন্য আদিষ্ট হয়েছি”। যিয়ারতের সময় তিনি বলেছেন, “হে কবরবাসী তোমাদের প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক, তোমরা যে অবস্থাতে আছো সেটি তোমাদের জন্য আরামদায়ক হোক (মুসনাদ, ১২/৪০৯)। এ ছাড়া ওহুদের শহিদানের যিয়ারত, তাঁর আব্বা-আম্মার যিয়ারত, শবে বরাতে কবর যিয়ারত ইত্যাদি হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। মিশকাত শরিফে যিয়ারতের বৈধতা ও গুরুত্ব বিষয়ক দশটি হাদিস আছে। ছহিহ বুখারি সহ হাদিসের প্রায় গ্রন্থে এ বিষয়ক পরিচ্ছেদ আছে। আল্লাহর নবি (দ.) এর যুগ থেকে এ আমল মুসলিম সমাজে চালু আছে। ইমামগণ সাধারণ মুসলমানের কবর যিয়ারতকে সুন্নাত হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। মোল্লা আলি এ বিষয়ে ইমামগণের ইজমা (ঐকমত্য) প্রতিষ্ঠিত হওয়ার কথা বলেছেন। আল্লাহর নবি (দ.)-এর মাজার যিয়ারতকে অত্যাধিক পূণ্যময় আমল বলে অধিকাংশ ইমাম মত দিয়েছেন। মালেকি মাজহাবের কেউ কেউ ওয়াজিব বলে ফতোয়া দিয়েছেন। হযরত ওমর, হযরত আলি, হযরত ইবন ওমর, হযরত জাবির, হযরত আনাস, হযরত মুয়াজ বিন জাবাল, হযরত বিলাল, হযরত আবু আইউব আনসারি (র.) সহ সাহাবিগণের একটি বড় দল যিয়ারতের উদ্দেশ্যে সফর করেছেন মর্মে বর্ণনা পাওয়া যায়। হযরত ঈসা বিন মারইয়াম (আ.) পৃথিবীতে পুনরায় আগমন করে আল্লাহর নবি (দ.)-এর যিয়ারতের উদ্দেশ্যে পবিত্র মদিনা সফর করবেন মর্মেও ছহিহ হাদিস আছে। আল্লাহর নবি (দ.) বলেন, “যে ব্যক্তি হজ করলো অথচ তাঁর যিয়ারতে আসল না সে আমার প্রতি অবিচার করলো”। অন্য হাদিসে আছে, যে আমার যিয়ারত করলো তার জন্য সুপারিশ করা আমার ওপর ওয়াজিব হয়ে যায়”। পবিত্র কুরআনে অবিশ্বাসী ও মুনাফিকের কবরে দাঁড়াতে আল্লাহর রাসূল (দ.)-কে নিষেধ করা হয়েছে। কবরে দাঁড়ানো মানে যিয়ারত করা। এর দ্বারাও প্রমাণিত হয় যে, মুসলমানের কবরে দাঁড়ানো তথা যিয়ারত করা জায়েয এবং সাওয়াবের কাজ। তাই কোন মানুষ মারা গেলে জানাযায় শরিক হয়ে দাফন পর্যন্ত অপেক্ষা করা এবং দাফন উত্তর কবরে দাঁড়িয়ে তার জন্য দোয়া করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। হযরত উসমান (র.) বলেন, আল্লাহর নবি (দ.) যখন কারো দাফনের কাজ শেষ করতেন তখন কবরে দাঁড়িয়ে বলতেন, “তোমরা তোমাদের ভাইয়ের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করো এবং তার দৃঢ়তার জন্য দোয়া করো। কেননা, সে এখন প্রশ্নের সম্মুখীন (সুনান আবু দাউদ, ১/৪৫৯)।

যিয়ারতের কয়েকটি ফযিলত সরাসরি হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। যেমন, মৃত্যুর কথা স্মরণ হওয়া, দুনিয়ার আকর্ষণ কমে আসা, অন্তর নরম হওয়া, চোখ দিয়ে পানি আসা, আখিরাতের কথা স্মরণ হওয়া, শিক্ষা গ্রহণ করা ইত্যাদি। ইবন নাবাতা তাঁর প্রসিদ্ধ খুতবাতে আল্লাহর নবি (দ.)-এর যিয়ারতের দশটি ফযিলত বর্ণনা করেছেন। মোদ্দা কথা হলো, কবর যিয়ারত সুপ্রতিষ্ঠিত ও বহুল প্রচলিত সুন্নতি আমল। এর বৈধতা নিয়ে ইমামগণের মাঝে কোন বিতর্ক নেই। তাঁদের মাঝে মতানৈক্য আছে মহিলারা কবর যিয়ারত করতে পারবে কিনা, যিয়ারতকালীন দোয়া কি কিবলামুখী হয়ে করবে, নাকি কবরবাসীর দিকে হয়ে করবে, অলি-বুযুর্গ বা নবি-রাসূলগণ (আ.)-এর নিকট সরাসরি কিছু চাওয়া যাবে কিনা, নাকি তাঁদের উসিলা দিয়ে চাইবে, কবর স্পর্শ করে সালাম করা যাবে কিনা ইত্যাদি বিষয়ে। উল্লেখ্য যে, মহিলারা আল্লাহর নবি (দ.)-এর যিয়ারত করতে পারবে- এ বিষয়ে মতানৈক্য নেই। এটি বর্তমানেও সৌদি সরকারের তত্ত্বাবধানে চলমান আছে। অতএব প্রমাণিত হলো যে, মুসলমানের কবর যিয়ারত বৈধ এবং সাওয়াবের কাজ। নেককার বান্দাদের যিয়ারত আরো বেশি সাওয়াবের আমল। আল্লাহর নবি (র.)-এর যিয়ারত আল্লাহর তায়ালার নৈকট্য লাভের অত্যাধিক গুরুত্বপূর্ণ আমল; পাপ মোচন ও শাফায়াত লাভের উসিলা। অলি-বুযুর্গ ব্যক্তির যিয়ারতের মাধ্যমে আধ্যাত্মিক উন্নতি লাভ করা যায়। ইমাম শাফেয়ি (র.) ইমাম আবু হানিফা (র.)-এর যিয়ারতের উদ্দেশ্যে সিরিয়া থেকে সফর করে কুফা যেতেন এবং এতে তিনি উপকৃত হতেন মর্মে তাঁর মত পাওয়া যায়; যা ফতোয়ায়ে শামীর ভূমিকায় উল্লেখ হয়েছে।
মাযার অর্থ যিয়ারতস্থল। শাব্দিক অর্থে প্রত্যেক মুসলমানের কবর হলো মাযার বা যিয়ারতস্থল। তবে পরিভাষায় প্রত্যেক মুসলমানের কবরকে মাযার হিসেবে গণ্য করা হয় না, বরং অলি-বুযুর্গ ও হক্কানি-রাব্বানি গ্রহণযোগ্য আলেম-ওলামাগণের কবরকে মাযার বলা হয়। আল-মু‘তামাদ আরবি অভিধানে বলা হয়েছে, “মাযার হলো অলিগণের সমাধিস্থল, যার যিয়ারত করা হয়”। কবর যিয়ারত নিয়ে কোন বিতর্ক না থাকলেও মাযার যিয়ারত, মাযার নির্মাণ, মাযার কেন্দ্রিক কিছু কর্মকাণ্ড নিয়ে মুসলিম সমাজে বিতর্ক আছে। সে আলোকে বর্তমান মাযারপন্থী ও মাযারবিরোধী হিসেবে দুটি পক্ষ বিরাজমান। কেউ কেউ মাযার শব্দটি শুনলেই নাক ছিটকায়; মাযার সংস্কৃতিকে গড্ডালিকায় বিদয়াত, শিরক বলে মন্তব্য করে। মাযার যিয়ারতকারী ও মাযার কেন্দ্রিক কার্যক্রম পরিচালনাকরীদেরকে মাযারপূজারী, কবরপূজারী বলতেও দ্বিধা করে না। অথচ পৃথিবীর প্রত্যেক মুসলিম দেশে মাযার আছে। মাযার কেন্দ্রিক কার্যক্রম আছে। নবি-অলি, সাহাবি, তাবেয়ি, ইমামগণের মাযার আছে। আল্লাহর নবি (দ.) ও তাঁর পাশে শায়িত দুই সাহাবির মাযার আছে এবং হরদম যিয়ারত চালু আছে। এমতাবস্থায় যিয়ারত ও মাযার সংস্কৃতি বিষয়ে অনেক মানুষ বিভ্রান্ত, বিশেষত বর্তমান প্রজন্ম; যদিও মাযার সংস্কৃতির প্রতি সিংহভাগ মুসলমানের বিশ্বাস এবং মাযারের প্রতি ভক্তি আছে। তবে এটা অস্বীকার করা যায় না যে, কিছু কিছু মাযারে শরিয়তবিরোধী কার্যক্রম চলে। দ্বীনধর্ম ও মানবতার কল্যাণে অনেক মাযারের হাদিয়া ব্যবহার হয় না; মাযারের আয়-ব্যয়ের হিসাব নেই। অনেক ভন্ড লোকেরও মাযার তৈরি করা হয়েছে এবং হচ্ছে। কিছু মাযারের আশেপাশে অবাঞ্চিত লোকের অবস্থান আছে। এগুলোর কারণে “লালসালু” জাতীয় উপন্যাস রচনার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। মূলত মাযার করা হয় যিয়ারতের সুবিধার্থে। রোদ-বৃষ্টি থেকে নিরাপদ থেকে সুন্দরভাবে যিয়ারত, তিলাওয়াত, দোয়া-দরূদ ও হিদায়াতি কাজের সুবিধার্থে মাযার সংস্কৃতির প্রচলন হয়েছে। তাই মাযার আগে নয়, যিয়ারত আগে। অর্থাৎ যিয়ারতের প্রয়োজনে মাযার ব্যবস্থা। এটাও অস্বীকার করা যায় না যে, প্রায় প্রত্যেক মাযারকে কেন্দ্র করে মসজিদ, মাদ্রাসা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, এতিমখানা, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মাযার ও মাযারওয়ালার বার্ষিক ওরসের হাদিয়া দিয়ে মানবিক কার্যক্রম পরিচালিত হয়। বেকারত্ব দূরীকরণ, কর্মসংস্থান সৃষ্টির মত কার্যক্রমও হচ্ছে। যিয়ারত ও মাযার সংস্কৃতির মাধ্যমে যুগ যুগ ধরে চলে আসা উল্লেখিত দ্বীনি ও মানবিক কার্যক্রমকে উপেক্ষা করে কিছু ভিত্তিহীন মাযার অথবা কিছু মাযারে চলমান শরিয়তবিরোধী কার্যক্রমের কারণে যিয়ারত ও মাযার সংস্কৃতিকে অবৈধ বলা বা এটাকে পূজার সাথে তুলনা করা সীমালঙ্ঘনের নামান্তর। এটি মাথা ব্যথা হলে ওষুধ সেবন না করে মাথা কেটে ফেলার উদাহরণও বটে। তাই যিয়ারতের মত সুন্নতি আমলকে বিতর্কিত না করে এর সঠিক পন্থা বর্ণনা করা প্রয়োজন। আর যে কোন অবৈধ কাজকে শিরক বা পূজার সাথে তুলনা করা অথবা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে মুশরিক, কাফির, পূজারী বলাও অনুচিত। কারণ, শিরক হলো সবচেয়ে বড় পাপ, যা আল্লাহ তায়ালা ক্ষমা করেন না। এটি সবচেয়ে বড় গালিও বটে। কাউকে যদি শিরক, কুফরির অপবাদ দেয়া হয় আর যদি সেটি যথাযথ না হয় তাহলে সেটি অপবাদদানকারীর দিকে ফিরবে অর্থাৎ নিজেই সেই পাপে অভিযুক্ত হয়ে যাবে (মুসলিম, হাদিস নং-৬০)। এ বিষয়ে সীমালঙ্ঘন ও শৈথল্য পরিহার করা উচিৎ। মাযার কেন্দ্রিক বিতর্কিত ও শরিয়তবিরোধী কাজ, যেনতেন লোকের মাযার, যে কারো স্বপ্নের ওপর ভিত্তি করে মাযার নির্মাণ, উরস-ফাতিহার নামে শরিয়তবিরোধী কার্যক্রম, মাযার হাদিয়ার অপব্যবহার, হাদিয়ার টাকাকে ব্যক্তিগত রোজগারের মাধ্যমে পরিণত করা ইত্যাদির কারণে মাযার সংস্কৃতি প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রয়োজন। সত্যিকার অলি-আল্লাহদের মাযার ও এগুলোকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কার ও উন্নয়ন দরকার। ধর্মমন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে মাযার পরিচালনা কমিটি বা ওয়ারিশগণের সমন্বয়ে প্রত্যেক মাযার ভিত্তিক কমিটি হতে পারে। এতে মাযার কেন্দ্রিক দ্বীনি ও মানবিক কাজগুলো আরো সুচারু হবে এবং অনুপ্রবেশ করা কুসংস্কারগুলো দূরীভূত হবে। শিক্ষা-দীক্ষা, ইসলামি সংস্কৃতিচর্চা, মানবিক কার্যক্রম আরো গতি পাবে।

ড. মুহাম্মদ নুর হোসাইন
সহযোগী অধ্যাপক, আরবি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

সূত্রঃ দৈনিক পূ্র্বকোণ, ২৫/০৬/২০২১।

[related_post themes="flat" id="1634"]